কুবি প্রতিনিধি:
শিক্ষকদের দাবির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত পদোন্নতি ব্যতীত সকল ধরনের বিধিবহির্ভূত নতুন নিয়োগ বন্ধ রাখার আহবান জানিয়েছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।
সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবু তাহের ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ড. মাহমুদুল হাসান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে উপাচার্যকে এই আহবান জানানো হয়।
চিঠিতে শর্ত পূরণ হওয়া সত্ত্বেও পদোন্নতি কিংবা স্থায়ীকরণ থেকে যারা বঞ্চিত হয়েছেন তাঁদের বিষয়টি নিষ্পত্তি করা, গত ১৯ ফেব্রুয়ারী উপাচার্যের কার্যালয়ে শিক্ষদের উপর হামলার বিচার, ২৮ এপ্রিল উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের নেতৃত্বে কতিপয় শিক্ষক, বহিরাগত সন্ত্রাসী ও বিভিন্ন মামলার আসামি সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের দ্বারা শিক্ষকদের উপর হামলার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রদান ও উক্ত রিপোর্টের প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত না করা পর্যন্ত সকল ধরনের নতুন নিয়োগ (শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী) কার্যক্রম বন্ধ রাখার অনুরোধ করা হয়।
এ বিষয়ে শিক্ষক সমিতির সহ সভাপতি ড. মোহাম্মদ কামাল উদ্দীন বলেন, উপাচার্য শিক্ষকদের দাবির প্রেক্ষিতে উদ্ভুত পরিস্থিতির সমাধান না করে নিয়োগের পায়তারা করছেন। যা কোনভাবেই কাম্য নয়। তিনি যদি শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিতেন তাহলে উদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।
এর আগে গত ৬ মার্চ নিজের পছন্দের দুই প্রার্থী (আব্দুর রাজ্জাক ও জান্নাতুন নেছা) কে ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগে নিয়োগ দিতে উঠেপড়ে লাগেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈন। বিধিবহির্ভূত নিয়োগ হওয়ায় ওই বোর্ডে উপস্থিতিও ছিলেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বোর্ড সদস্য। নির্ধারিত সময়ের ২ ঘণ্টা পর পরীক্ষা শুরু করতে গেলে নির্দিষ্ট প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে এই পরীক্ষার আয়োজন করা হয়েছে বলে দাবি করেন শিক্ষকরা। এসময় উপাচার্যের কক্ষে শিক্ষক কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে উপাচার্যকে প্রশ্নপত্র টাইপিং করতে দেখা যায়। পরবর্তীতে প্রশ্নপত্র সিলগালা না করে কর্মচারীকে দিয়ে পরীক্ষার হলে প্রশ্ন প্রেরণ করে। এসময় কোন নিরাপত্তা ছাড়া প্রশ্নপত্র উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষের হাতে দেখা যায়। এছাড়াও নিয়োগ পরীক্ষা শুরুর আগে থেকেই উপাচার্যের দপ্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিপ্রার্থী সাবেক শিক্ষার্থীদের অবস্থান করতে দেখা যায়। পরে শিক্ষকদের দাবির মুখে এই বোর্ড স্থগিত করে কর্তৃপক্ষ।
২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারী নানা অনিয়ম ও আপত্তির পরেও মার্কেটিং বিভাগে আলোচিত ও বিতর্কিত প্রার্থী আবু ওবায়দা রাহিদের নাম শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। ভাইভা বোর্ডে অংশ নেওয়া অধিকতর ভালো ফলাফলধারী প্রার্থীদের বাদ দিয়ে নিয়োগের জন্য চূড়ান্তভাবে সুপারিশ করা হয় তুলনামূলক অনেক কম ফলাফলধারী রাহিদের নাম। শুধু এ প্রার্থীকে নিতেই তার যেসব যোগ্যতা আছে, সেগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কৌশলে বাড়তি একটি অনুবিধি যোগ করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে কুবি কর্তৃপক্ষ।
কুবির শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী চাকরিপ্রার্থীর উভয় ফলাফল (স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের) ন্যূনতম ৩ দশমিক ৭০ হতে হবে। কিন্তু রাহিদের স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের ফলাফল যথাক্রমে ৩ দশমিক ৫৬ ও ৩ দশমিক ৫৪। অথচ একই মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়া অন্য তিন প্রার্থী রাবেয়া জান্নাত, গৌতম সাহা ও জাহিদুল ইসলাম পাটোয়ারীর ফলাফল এর চেয়ে ভালো। তাদের স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের ফল ছিল যথাক্রমে ৩.৯৩ ও ৩.৯৫, ৩.৭৭ ও ৩.৮৮ এবং ৩.৭৭ ও ৩.৯০। এ ছাড়া লিখিত পরীক্ষার উত্তরপত্রে রাহিদকে যাতে শনাক্ত করা যায় সেইজন্য উত্তরপত্রে একটি চিহ্ন রাখার অভিযোগ রয়েছে।
২০২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী অভ্যন্তরীণ প্রার্থী ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আকবর হোসেন ও রেঁনেসা আহমেদ সায়মাকে স্থায়ী না করে সেখানে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ইসরাত জাহান নিমনীকে। যিনি এর আগে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁকে নিয়োগের ব্যাপারে সুপারিশ করেনি বিভাগীয় প্ল্যানিং কমিটি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রেজাল্টের জন্য যেই শর্ত রয়েছে সেটিও ছিল না এই প্রার্থীর। কিন্তু এই প্রার্থীকে নিতে ইউজিসির অভিন্ন নীতিমালার শর্ত ও কুবির শর্ত দুইটিই উল্লেখ করেন কর্তৃপক্ষ।
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের রেজাল্টের শর্তে একটিতে সিজিপিএ ৩.৫০ এবং অন্যটিতে ৩.৩৫ চাওয়া হয়েছে। তবে ইউজিসির অভিন্ন নীতিমালা অনুযায়ী, সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের রেজাল্টের শর্তে একটিতে সিজিপিএ ৩.৫০ এবং অন্যটিতে ৩.২৫ উল্লেখ করা হয়েছে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী এই প্রার্থীর রেজাল্ট কম রয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষ এই প্রার্থীকে নেওয়ার জন্য অভিনব কায়দায় বিজ্ঞপ্তিতে দুইটি শর্ত উল্লেখ করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এছাড়া বিভাগীয় প্ল্যানিং কমিটি সুপারিশ না করলেও রেজিস্ট্রার দপ্তর আইন অমান্য করে এই প্রার্থীকে বাছাই করে।
কর্তৃপক্ষের এমন অনিয়ম ও অসামঞ্জস্যতার বিষয়ে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান বলেন, উপাচার্য একজন আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজ। তাঁর মোটো হচ্ছে দুর্নীতি করে উন্নতি করা। যেটা তিনি অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে ছাত্রদের সামনে বলেছেন। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের আগে তথ্য গোপন করে উপাচার্য হয়েছেন। উপাচার্য হওয়ার পর প্রথমদিন থেকেই তিনি দুর্নীতি শুরু করেছেন। এতো নির্লজ্জ কোন প্রশাসক হতে পারে এটা আমার কল্পনার বাইরে। শিক্ষক নিয়োগে প্রচলিত যেই নিয়মনীতি রয়েছে সেগুলো না মেনে আইনের ব্যত্যয় করে নিয়োগ প্রদান করেন। ইতোমধ্যে তিনি বিভিন্ন বিভাগে নীতিমালা বহির্ভূত একাধিক শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। এর ফলে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছেন সে কারণে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম এখন ব্যহত হচ্ছে। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রান্তিলগ্ন যাচ্ছে সেখানে তিনি এই সংকট উত্তোরণ না করে নিয়োগ বাণিজ্যে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। ৩০ জুনের মধ্যেই তিনি বিভিন্ন পদে প্রায় অর্ধশত নিয়োগ উৎসব করতে যাচ্ছেন বলে আমরা বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানতে পেরেছি। যেহেতু অল্প সময়ে তিনি এই নিয়োগ প্রক্রিয়াগুলো করবেন এতে বুঝা যাচ্ছে তিনি একেবারেই ক্রিমিনাল মাইন্ডসেট নিয়ে আছেন। এখানে তার অন্যতম সহযোগী হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ। যার মেয়াদ আগামী ১০ ই জুলাই শেষ হবে। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তিনি বিশাল আর্থিক দূর্নীতির জন্য উপাচার্যের দুর্নীতির দোসর হিসেবে মনোনিবেশ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল আইন কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তাঁরা এই নিয়োগের পায়তারা করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়োগের সকল নীতিমালা ভঙ্গ করে তিনি যে অবৈধ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন তার বিপরীতে আমরা লিখিত দিয়েছি। তারপরেও যদি তিনি এসব নিয়োগ সম্পন্ন করার দু:সাহস দেখান তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি স্টেকহোল্ডার সেটির প্রতিরোধ করবে।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষকরা যখন শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কার্যক্রম ব্যহত হওয়ার বিষয়গুলো সমাধানের পথে এগুচ্ছেন সেই সময়ে তিনি আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর যে অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্য এবং আর্থিক দূর্নীতি সেগুলোর দিকেই তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। এই অবস্থায় আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে আহবান জানাচ্ছি তাঁরা যাতে এই বিষয়ে সচেতন এবং সজাগ সেই বিষয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তাঁকে দ্রুত অপসারণ করে। কারণ শিক্ষকদের উপর হামলা করে কোন উপাচার্য এতটা ন্যাক্কারজনক উদাহরণ কোথাও তৈরি করেনি। এই কলঙ্কের দায় নিয়ে এখানে শিক্ষকতা করা কোনভাবেই সম্ভব না। আমরা চাই অচিরেই এই সন্ত্রাসী উপাচার্যকে অপসারণ করা হোক। গত ছয় মাসে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে তিনি এখন পর্যন্ত কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তিনি একজন প্রশাসনিক প্রতারক এবং মিথ্যাবাদী ব্যক্তি। তিনি আসলেই কোন সমাধান চান না। তাঁর কাজই হচ্ছে বিশৃঙ্খলার মাধ্যমে তাঁর দুর্নীতির কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈনের অর্ধশত প্রার্থীকে বিধিবহির্ভূত নিয়োগের সত্যতার ব্যাপারে জানতে তাঁর সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
আপনার মতামত লিখুন :