চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ—সংক্ষেপে (চাকসু)। শুধু একটি সংগঠন নয়, বরং এটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চিন্তা-চেতনা, অধিকার আদায় এবং নেতৃত্ব বিকাশের প্রাণকেন্দ্র। প্রতিষ্ঠার সময় ১৯৬৬ সালে এর উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মানোন্নয়ন, সৃজনশীল নেতৃত্ব তৈরি এবং বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ করে দেওয়া।
চাকসুর ইতিহাস জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গেও। মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনে চাকসু হয়ে ওঠে সংগ্রামের অগ্রভাগের সংগঠন। দেশের স্বাধীনতার পক্ষে সচেতনতা গড়ে তুলতে এবং মুক্তিকামী ছাত্রসমাজকে একত্রিত করতে চাকসু রেখেছিল গুরুত্বপূর্ণ অবদান। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রায় ৬০ বছরে মাত্র ছয়বার হয়েছে ছাত্র সংসদ নির্বাচন।
১৯৯০ সালের পর তিন দশকেরও বেশি সময় কেটে গেছে নির্বাচনের আলো না দেখেই। এ সময়টা শিক্ষার্থীদের জীবনে ছিল রাজনীতির দখলদারিত্ব, সহিংসতা, গণরুম সংস্কৃতি ও ভীতিকর পরিবেশের। চাকসু ভবনও হয়ে ওঠে নিছক আড্ডাখানা। কিন্তু ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান যেন হারানো স্বপ্ন ফিরিয়ে দিয়েছে। ১৫ অক্টোবর সপ্তমবারের মতো অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে চাকসু নির্বাচন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর এই আয়োজন শিক্ষার্থীদের মনে নতুন প্রত্যাশার আগুন জ্বেলে দিয়েছে।
আজ পাহাড়ঘেরা সবুজ ক্যাম্পাসে এবার শিক্ষার্থীদের কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে চাকসু নির্বাচনের স্লোগান।
চাকসু নিয়ে শিক্ষার্থী তথা প্রার্থীদের ভাবনার কথা তুলে ধরছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী -ছাদেক হোছাইন।
ছাদেক হোছাইন | শিক্ষা ও গবেষণা ইনিস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় | কার্যনির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল:sadekcu629@gmail.com
১.শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক প্ল্যাটফর্মকে স্থায়ী করতে কাজ করবো
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ তথা (চাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে দীর্ঘ ৩৫ বছর পর। ছাত্রদের অধিকার আদায়ের এই প্রতিষ্ঠান সচল হচ্ছে এটাই আমাদের জন্য অনেক বড় পাওনা। আমি চাকসুতে জিএস পদে নির্বাচন করতেছি এবং নির্বাচিত হলে আমি চাকসুকে স্থায়ী সচল রাখতে একাডেমিক ক্যালেন্ডারে অন্তর্ভুক্ত করতে কাজ করবো। কোন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনকে ছাত্রদের অধিকার আদায়ের দায়িত্ব বর্গা যেন দিতে না হয় তারজন্য চাকসু হওয়া খুবই জরুরী। দীর্ঘদিন পর চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে দেখে আমরা প্রার্থী থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী ভাই ও বোনদের উচ্ছাস দেখতে পাচ্ছি। যা আমাদের আরো প্রাণবন্ত ও দায়িত্ববোধে দায়বদ্ধ হতে সহযোগিতা করতেছে। সিনেটে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি না থাকায় শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সবসময় উপেক্ষিত হয়ে আসছে, চাকসু মাধ্যমে আমরা শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সকল কিছু প্রশাসন ও রাষ্ট্র থেকে আদায় করবো ইনশাআল্লাহ। এবং এই যাত্রায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইও বোনেরা আমাদের পাশে থাকবে বলেই আমি বিশ্বাস করি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানে চাকসু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি। সমস্যাগুলো সমাধানে আমার নির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে, আমি নির্বাচিত হলে নির্বাচিত সকল প্রতিনিধি নিয়ে এসব সমস্যা সমাধান করবো। তবে আমি বিশ্বাস করি, যেই নির্বাচিত হোক সে অবশ্যই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করবে এবং সমাধান করবে।
নাম:- রশিদ দিনার | সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদপ্রার্থী সেশন:- ১৯-২০( ইতিহাস বিভাগ)
২.চাকসুকে প্রাণবন্ত করতে চাই যোগ্য নেতৃত্বের উত্থান
আমি সাখাওয়াত হোসাইন শিপন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে। দীর্ঘ তিন যুগ পর বহুল প্রত্যাশিত চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তবে এই নির্বাচন তখনই স্বার্থক হবে, যখন শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে সাহসী কণ্ঠে কথা বলার মতো প্রকৃত নেতৃত্ব উঠে আসবে। শুধু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেই চলবে না, নির্বাচনের পর শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে দৃশ্যমান কার্যক্রম থাকতে হবে। অন্যথায় শিক্ষার্থীরা চাকসুর প্রতি আস্থা হারাবে এবং বিমুখ হয়ে পড়বে। তাই সময়ের দাবি হলো স্বচ্ছ, যোগ্য ও দায়িত্বশীল নেতৃত্বের উত্থান। একইসাথে চাকসু প্রার্থীদের ইশতেহার হতে হবে সার্বজনীন, শিক্ষার্থীবান্ধব এবং বাস্তবসম্মত, যেন তা প্রতিটি শিক্ষার্থীর প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটায়। শুধুমাত্র এমন নেতৃত্বই চাকসুকে প্রাণবন্ত ও কার্যকর প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।
সাখাওয়াত হোসাইন শিপন , যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদপ্রার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ২০১৮-১৯
৩. নারীদের অগ্রযাত্রায় চাকসু হবে শক্তির প্ল্যাটফর্ম
চাকসু শিক্ষার্থীদের স্বার্থ, অধিকার ও কল্যাণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম। আমি চাই এটি আরও স্বচ্ছ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সক্রিয় হোক, যাতে শিক্ষার্থীরা নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারে, সমস্যা দ্রুত সমাধান হয় এবং সকলের স্বার্থ রক্ষা পায়। বিশেষভাবে, আমি নারীদের নিরাপত্তা ও মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিচ্ছি, যারা সাইবার বুলিং, ট্যাগিং বা অনলাইন ও সামাজিক মাধ্যমের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হয়। আমি চাই এমন কার্যক্রম ও সচেতনতা গড়ে উঠুক যা এই সমস্যা প্রতিরোধ করতে সহায়তা করবে। চাকসু শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর, শক্তি ও পরিবর্তনের শক্তিশালী মাধ্যম।
আমি চাই এমন একটি পরিবেশ যেখানে প্রতিটি ছাত্রী স্বাচ্ছন্দ্যে হাঁটতে পারে, সমস্যায় পড়লে জানে কোথায় যাবে, এবং স্বপ্ন পূরণের পথে কারও সহায়তার অভাব হয় না। ক্যাম্পাস হলো আমাদের বেড়ে ওঠার জায়গা, যেখানে আমরা শুধু পড়াশোনা ও গবেষণা নয়, মানুষ হওয়াও শিখি। তাই আমি চাই এখানে ভয় নয়, নিরাপত্তা থাকুক; বঞ্চনা নয়, সমান সুযোগ থাকুক; নীরবতা নয়, স্বাধীন কন্ঠস্বর থাকুক।
আমি বিশ্বাস করি, একজন নারী যখন এগিয়ে যায়, সে এগিয়ে যায় আশেপাশের সবাইকে সাথে নিয়ে। আমি সেই নারীদের জন্য পথ তৈরি করতে চাই, যাতে আগামী দিনের প্রতিটি ছাত্রী আরও সাহসী, আরও শক্তিশালী ও সৃজনী মনন নিয়ে সামনে আসতে পারে।
রোবাইদা খানম ওহি, সহ-ছাত্রী কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক পদপ্রার্থী, বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য, ২১-২২ সেশন, ম্যানেজমেন্ট বিভাগ
৪.দলীয় রাজনীতি নয়, শিক্ষার্থীদের স্বার্থেই চাকসু
দীর্ঘ ৩৫ বছর পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে, যা নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি রোমাঞ্চকর মুহূর্ত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকসু নির্বাচন কেবল একটি ভোট নয়, এটি আমাদের শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত স্বপ্ন, অধিকার এবং দায়িত্বের প্রতিফলন। এত বছর পর ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ফলে ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক চর্চা ফিরে আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি যে চাকসু শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি, সমস্যা সমাধান এবং নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের কেন্দ্রবিন্দু হবে। শিক্ষার্থীরা তাদের নেতৃত্ব নির্বাচন করার এবং তাদের অধিকার ও দাবি নিয়ে কথা বলার জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্ল্যাটফর্ম পাচ্ছে।
নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ব্যক্তিগত স্বার্থের বাইরে গিয়ে সত্যিকার অর্থে শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠা উচিত। নির্বাচনে প্রার্থী যেই আসুক না কেন, শিক্ষার্থীরা আশা করবে তারা শিক্ষার মান উন্নয়ন, আবাসন সমস্যা সমাধান, নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা এবং সহায়ক গবেষণা পরিবেশ তৈরির মতো মৌলিক বিষয়গুলিকে গুরুত্ব দেবেন। ছাত্র সংসদ কেবল দলীয় রাজনীতির হাতিয়ার নয় বরং শিক্ষার্থীদের স্বার্থের প্রতীক হওয়া উচিত। সবুজ ক্যাম্পাস, প্লাস্টিকমুক্ত নির্বাচন এবং সামাজিক সচেতনতার জন্য চাকসুকে রূপান্তরিত করা।
মো দিদার আলী সরকার, সোহরাওয়ার্দী হল সংসদেস মাজসেবা, পরিবেশ ও মানবাধিকার সম্পাদক পদপ্রার্থী।সেশন: ২০-২১
mddidarali23665@gmail.com
৫.চিন্তা, চেতনা ও শিল্পকলার তীর্থভূমি হোক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সাহিত্য ও সংস্কৃতি আমাদের আত্মার খাদ্য, চেতনার বাতিঘর। এই উপলব্ধি থেকেই আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে আরও সৃজনশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রাণবন্ত করে তোলার প্রত্যয়ে আমি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি। আমার বিশ্বাস, ছাত্র সংসদ কেবল প্রশাসনিক একটি সংস্থা নয়; এটি শিক্ষার্থীদের চিন্তাশীলতা, শিল্পচেতনা ও সৃজনশীলতার উন্মেষ ঘটানোর মঞ্চ।
তাই আমার অঙ্গীকার—কবিতা পাঠ, সাহিত্য আড্ডা, বিতর্ক, পাঠচক্র, সাংস্কৃতিক উৎসব ও নান্দনিক আয়োজনের মাধ্যমে ক্যাম্পাসকে সমৃদ্ধ ও প্রাণচঞ্চল করে তোলা। আমি চাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠুক কেবল জ্ঞানের নয়, বরং সাহিত্য ও সংস্কৃতিরও উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। অতএব, আসুন— মিলিতভাবে আমাদের ক্যাম্পাসকে পরিণত করি জ্ঞান ও শিল্পকলার এক অনন্য তীর্থভূমিতে।
হাবিব উল্লাহ রিফাত, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও প্রকাশনা সম্পাদক,১৯-২০ সেশন, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
৬.চাকসু নির্বাচন:শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের পথিকৃৎ
১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকসু হয়েছে মোট ৭ বার! অবাক হচ্ছেন? ৬০ বছরের ইতিহাসে ১৯৯০ এর পর শিক্ষার্থীরা তাদের অধিকার আর প্রয়োগ করতে পারেনি।এই নতুন বাংলাদেশ আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে থাকা সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার যাতে তারা তাদের যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে নেতা নির্বাচন করে সকল সমস্যার সমাধান করবে।আমাদের আবাসন,শহর থেকে ক্যাম্পাস চলাচল,মেডিকেলের নাপা আর অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস থেকে শুরু করে সেশন জট,লাল ফিতার দৌরাত্ম সহ শত সমস্যায় জর্জরিত আমার এই ক্যাম্পাস,তাই আমি শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে তাদের কণ্ঠস্বর হতে চাই এবং এর সমাধান করতে চাই।
নাম:সোলায়মান রহমান | কেন্দ্রীয় সংসদে নির্বাহী সদস্য সেশন: ২০২১-২২
আপনার মতামত লিখুন :