কুবি প্রতিনিধি:
গঠনতন্ত্র পরিপন্থি আচরণের অভিযোগ এনে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) শিক্ষক সমিতির তিন সদস্যের সদস্যপদ বাতিল করা হয়েছে। রোববার (২ জুন) শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেহেদি হাসান স্বাক্ষরিত পৃথক চিঠিতে এ তথ্য জানা যায়।
বহিষ্কৃত শিক্ষকরা হলেন, লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক রাশিদুল ইসলাম শেখ, ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী ওমর সিদ্দিক রানা ও অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আসাদুজ্জামান শিকদার।
চিঠিতে বলা হয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির গঠনতন্ত্রের অনুচ্ছেদ ১৪ অনুযায়ী গত ২৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিক্ষক সমিতির সদস্যপদ সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়। সদস্যপদ কেন বাতিল করা হবে না এই মর্মে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে শিক্ষক সমিতির সভাপতি বরাবর জবাব প্রদানের জন্য কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রেরণ করা হয়।
শিক্ষক সমিতির সভাপতি বরাবর জবাবটি কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় সন্তোষজনক হিসেবে বিবেচিত হয়নি। এর প্রেক্ষিতে গত ২৮ মে অনুষ্ঠিত শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভায় সদস্য পদ বাতিল সংক্রান্ত প্রস্তাব উপস্থাপিত হলে সভায় উপস্থিত সদস্যদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সদস্যপদ বাতিল করা হলো।
এর আগে ২৭ এপ্রিল কোষাধ্যক্ষের সাথে কথা বলার সময় লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ও আইকিএউসির পরিচালক অধ্যাপক রশিদুল ইসলাম শেখ শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহেরকে মারতে তেড়ে যান। ২৮ এপ্রিল বহিরাগতদের নিয়ে তালা ভাঙ্গা এবং শিক্ষকদের উপর হামলায় অংশ নেন তিনি।
একইদিনে প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) কাজী ওমর সিদ্দিকী একজন নারী শিক্ষকের সাথে উচ্চবাচ্য করেন। ২৮ এপ্রিল উপাচার্যের নেতৃত্বে হামলার সময় শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক কে ঘুষি মারেন। বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এসব কর্মকান্ডের মাধ্যমে তিনি মূলত উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আব্দুল মঈনের প্রশাসনকে বিপদগামী করছেন। এমনকি নিয়োগের পর থেকেই তিনি প্রতিটি উপাচার্যের শুরুর দিকে উপাচার্য থেকে বিভিন্ন পদে ভাগিয়ে নিয়ে স্বার্থ উদ্ধার করেন এবং শেষ সময়ে এসে তার বিরুদ্ধাচারণ করেন।
প্রক্টর হওয়ার পর থেকেই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে বিভিন্ন হামলায় ইন্ধন দেওয়ার। ২০২২ সালের ২২ মার্চ কাজী ওমর সিদ্দিকীর ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর হিসেবে নিয়োগের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭২ জন সহযোগী অধ্যাপক এবং ২০ জন অধ্যাপক কর্মরত ছিলেন। সহকারী অধ্যাপক হয়েও তিনি প্রক্টরের পদ ভাগিয়ে নেন। যা বিশ্ববিদ্যালয় আইনের সুস্পষ্ট ব্যত্যয়।
২০২২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ছাত্রলীগের সংঘর্ষের ঘটনায় ৩০ থেকে ৩৫ জন নেতাকর্মী গুরুতর আহত হন। প্রক্টরিয়াল বডি কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় দুই দিন ধরে চলতে থাকে এ সংঘর্ষ।
গত বছরের ১ অক্টোবর শাখা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্তির গুজব ছড়ালে শাখা ছাত্রলীগের ২০১৭ সালে বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক রেজা-ইলাহী সমর্থিত কয়েকজন নেতাকর্মী শতাধিক বহিরাগত নিয়ে প্রবেশ করে ফাঁকা গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটনায়। এদের মধ্যে স্থানীয় দোকানদার, সিএনজি চালকসহ অছাত্র ও হত্যা মামলায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া আসামিও ছিলেন। তাদের প্রবেশের সময় ক্যাম্পাস ফটকেই অবস্থান করছিলেন প্রক্টর। তার সামনে বহিরাগতরা গুলি ছুড়লেও তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি।
২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি অছাত্র ও হত্যা মামলার আসামি বিপ্লব দাসের নেতৃত্বে কয়েকজন অছাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে উঠতে গেলে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে প্রক্টর বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন। এক অছাত্র দাবি করেন, প্রক্টরের নির্দেশেই তারা হলে উঠার চেষ্টা করেন। বাকবিতন্ডার জের ধরে গত ৭ মার্চ এনায়েত উলস্নাহ ও সালমান চৌধুরীকে সাময়িক বহিষ্কার করে কুবি প্রশাসন।
২০১৬ সালে নিহত খালেদ সাইফুলস্নাহ হত্যা মামলার প্রধান আসামি বিপ্লব দাসকে সন্ধ্যাকালীন কোর্সে ভর্তি হতে সুযোগ করে দেওয়ারও অভিযোগ ওঠে প্রক্টরের বিরুদ্ধে। হত্যা মামলায় জবানবন্দি দেওয়া আসামিকে ফের ভর্তির সুযোগ করে দিতে ওমর সিদ্দিকীর যোগসাজশেই এ সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন।
ওই বছরের ৮ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন আল আমিনের দোকানের সামনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হলের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এনায়েত উলস্নাহ ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সালমান চৌধুরী ও বিজ্ঞান অনুষদের সহ-সভাপতি সাইদুল ইসলাম রোহানকে বেধড়ক মারধর করে সেই বিপ্লব চন্দ্র দাস ও স্থানীয় যুবদল কর্মী রনি মজুমদার। ছাত্রলীগ নেতাদের দাবি, প্রক্টরের ইন্ধনেই তাদের ওপর হামলা করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পে ভূমি বাণিজ্যের সঙ্গে তিনি জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। জমি অধিগ্রহণের বিভিন্ন নথি থেকে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকী ভূমি অধিগ্রহণের আগে ৬১১৩ এবং ৬১১৪ নম্বর দাগে নিজের নামে জমি ক্রয় করে রাখেন। অন্য ব্যক্তির নামেও জমি কিনেছেন তিনি। ৬১১৪ নম্বর দাগে জমির দখলদার আবদুর রাজ্জাক ও আবদুছ সালাম হলেও সেখানে কাজী ওমর সিদ্দিকীর মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে।
বিগত উপাচার্য অধ্যাপক ডক্টর এমরান কবির চৌধুরীর মেয়াদের শুরুর দিকে ২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল ওমর সিদ্দিকী কাজী নজরুল ইসলাম হলের প্রাধ্যক্ষ পদ নেন। তার আমলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ কমিটির সদস্য হন তিনি। তবে তার মেয়াদের শেষদিকে বিভিন্ন ইস্যু তৈরি করে এমরান কবিরের বিরোধিতা করেন কাজী ওমর সিদ্দিকীসহ শিক্ষকদের একটি অংশ। এছাড়াও তাঁর বিরুদ্ধে ছুটিবিহীন পিএইচডি নেওয়া, পাহাড় কেটে রেস্টুরেন্ট করাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে বহিষ্কৃত আরেক আরেক শিক্ষক হলেন অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আসাদুজ্জামান শিকদার। ২৮ এপ্রিল শিক্ষক সমিতিকে ‘তালা সমিতি’ বলে বহিরাগত শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষক সমিতির রুম তালা মারার নির্দেশ দেন।
এদিকে বহিষ্কারের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) কাজী ওমর সিদ্দিকী জানান, শিক্ষক সমিতির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আমাদের কোনোভাবেই বহিষ্কার করতে পারে না। এর আগে যে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে সেটিও গঠনতন্ত্র মোতাবেক হয়নি। ২৭ তারিখে সাধারণ সভা করার কথা থাকলেও তারা ২৮ তারিখ সাধারণ সভা করেছে। সেটিও অবৈধ। এখানে যে অভিযোগ এনে বহিষ্কার করা হয়েছে তাহলে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসানের সবার আগে বিচার হওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, আমার এখন আলোচনায় আছি ৩জন। আমরা নিজেরা আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব।
আপনার মতামত লিখুন :