সৌন্দর্য দিয়ে মানুষকে সাময়িক সময়ের জন্য আটকানো যায়, সৌন্দর্য মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে তবে ব্যক্তিত্ব মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। ফেসবুক দিয়েই শুরু করা যাক। আধুনিক সভ্যতার চরম উৎকর্ষতার এই যুগে ফেসবুক একটি জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, পরিসংখ্যান বলছে বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ কোটির অধিক লোক ফেসবুক ব্যবহার করে আর পৃথিবীতে প্রায় তিনশো কোটি। ফেসবুক দিয়েই কেন লেখা শুরু করলাম? কারণ জনসংখ্যার বড় একটা অংশ এখন ফেসবুকমুখী, সময় আর সুযোগ পেলেই ফেসবুকে ঢু্ঁ মেরে আসে আবার অনেকের অবসর সময় কাটে ফেসবুক চালিয়ে। একটি ফেসবুক আইডিতে একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, রুচি, মানসিকতা, আদর্শ, চিন্তার পরিধি ইত্যাদি ফুটে ওঠে। একজন ব্যক্তির টাইমলাইম ঘুরে আসলে তাঁর ব্যক্তিত্ব, রুচি ও মানসিকতা সম্পর্কে অনেকটা ধারণা নেওয়া যায়। যদিও মানুষের মনের খবর আল্লাহ ভালো জানেন কিন্তু বাহ্যিক দেখেই আমরা সাধারণত মানুষকে বিচার করে থাকি। যেহেতু ফেসবুক আইডির এক্টিভিটিজ একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পরিচয় বহন করে অনেকাংশে সেহেতু ফেসবুক ব্যবহারে সচেতনতা ও মনোযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়।
এবার যদি শিরোনামে দৃষ্টি নিবন্ধ করি তাহলে ব্যক্তিত্বের সংজ্ঞায়ন দাবী রাখে, ব্যক্তিত্ব কি? ইংরেজিতে বলে Personality, ব্যক্তিত্ব বলতে পরিবেশগত ও শারীরিক উপাদানের প্রভাবে বিকশিত চারিত্রিক উদাহরণ আচরণ বোধ ও আবেগকে বুঝায়, মনোবিজ্ঞানে ব্যক্তিত্ব হচ্ছে – কোন একজনের মানসিক পক্রিয়া ও আচরণে এমন এক স্বতন্ত্র ধরণ যা কেবল তার মধ্যেই বিদ্যমান থাকবে যেটি কিনা অন্যদের কাছ থেকে সেই ব্যক্তিকে আলাদা করবে। আরেকটু সহজ করে বললে – ব্যক্তিত্ব হলো একজন ব্যক্তির এমন গুণ/বৈশিষ্ট্য যা অন্যের কাছে তাকে আকর্ষণীয় করে তুলবে এবং অন্যের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবে।
আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ তার ব্যক্তিত্বের কারণেই কোথাও স্মরণীয় কোথাও সম্মানীয় আবার ব্যক্তিত্বহীনতার কারণে কোথাও নিন্দনীয়। মূলত ব্যক্তিত্ব একজন মানুষকে আলোকিত করে সেক্ষেত্রে নিজের ব্যক্তিত্ব নিজেকেই নির্মাণ করতে হয়। ব্যক্তিত্ববান মানুষ হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা বা প্রচেষ্ঠা অনেকের মাঝেই বিরাজমান, কারণ ব্যক্তিত্ববান মানুষকে সবাই পছন্দ করে, একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব কেমন তা প্রকাশ পাবে তার আচরণে, মানুষ তার মনের মধ্যে কি চিন্তা লালন করে তার প্রকাশ পায় আচরণে। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষেরা সব জায়গায় তার ব্যক্তিত্বের ছাপ ফুটিয়ে তুলে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মধ্যে যে সকল গুণ থাকলে আমরা ব্যক্তিত্ববান হিসেবে গণ্য করি কিংবা ব্যক্তিত্ববান হওয়ার জন্য যে গুণগুলো থাকা দরকার এবার তাহলে সে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক।
(ক) অন্যকে সম্মান দেওয়া- একটা প্রবাদ আছে এরকম “বড় যদি হতে চাও ছোট হও তবে” কাউকে সম্মান দিয়ে কথা বললে কাউকে গুরত্ব দিলে মূলত নিজের সম্মানই বৃদ্ধি পায়, আপনি যখন কাউকে সম্মান দিয়ে কথা বলবেন তখন তার মধ্যে আপনার প্রতি সম্মানবোধ তৈরি হয়ে যাবে। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষেরা অন্যকে সম্মান দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
(খ) জ্ঞানগত যোগ্যতা বাড়ানো- জ্ঞানচর্চা আলোকিত ব্যক্তিত্ব তৈরির সহায়ক। কুরআন বলছে-“যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান হতে পারে?(যুমার-৯)”। মানুষ তাকেই বেশি পছন্দ করে সমীহ করে যার কাছ থেকে নতুন কিছু শিখতে পারে, জ্ঞানগত যোগ্যতা মানুষকে মানুষের কাছে আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলে।
(গ) কথা দিয়ে কথা রাখা – কথা দিয়ে কথা রাখার মধ্যে মানুষের ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। মানুষ সামাজিক জীব, চলাফেরায় একজন আরেকজনের মুখাপেক্ষী হতে হয়, টাকা ধার নিলে সময়মত পরিশোধ করা, কাউকে অপেক্ষায় রেখে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তার সাথে সাক্ষাৎ করা, কাজ করে দেওয়ার কথা বলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে করে দেওয়া সুন্দর ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। বন্ধুকে বা সহকর্মীকে পাঁচ মিনিটের কথা বলে ঘন্টা সময় অপেক্ষায় রাখা এদেশে অহরহ যা খুবই বিরক্তিকর।
(ঘ) কথা কম বলা- কথা কম বলা মানুষের উত্তম গুণগুলোর অন্যতম। স্বাভাবিকভাবে যারা চুপ থাকে, কথা কম বলে আমরা তাদেরকে গম্ভীর বা শান্তশিষ্ট হিসেবেই গণ্য করি। কথা যাই বলা হবে তা ভেবে চিন্তে বলা উচিত, কেননা মুখের কথা ও ধনুকের তীর দুটোই একই রকম, কারণ দুটি যদি একবার বেরিয়ে যায় ওটাকে আর ফেরানো যায়না। সাধক সত্যানন্দ বলেছিলেন “অনেক কথায় অনেক দোষ, ভেবে চিন্তে কথা কোস”, তাই যখনই মানুষ ভেবে চিন্তে কথা বলে তখন কথা কমই বলে এবং এর মধ্য দিয়ে আপনার মূল্য বাড়বে, যেকোন পরিবেশে প্রয়োজনের বেশি কথা না বলে অন্যের কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনার মধ্যে ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। “ইসলাম ধর্মে চুপ থাকাকে ইবাদত বলা হয়েছে(তিরমিজি)”।
(ঙ) চরিত্রবান হওয়া- চরিত্র মানুষের অমূল্য সম্পদ, চরিত্র অনেকগুলো গুণের সমষ্টি, যার চরিত্র নাই তার দ্বীন নাই কর্ম নাই। চরিত্রকে বাদ দিয়ে ব্যক্তিত্ব চিন্তাই করা যায়না, যার চরিত্র যত সুন্দর তার ব্যক্তিত্ব তত বেশি উজ্জল, চরিত্র অক্ষুণ্ণ থাকলে ব্যক্তিত্ব অটোমেটিকলি অক্ষুণ্ণ থাকবে। বিশ্বনবী সাঃ বলছেন – আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় সে যার চরিত্র ভালো(বুখারী-৩৪৭৬)।
(চ) ব্যক্তিগত বিষয় অন্যকে শেয়ার না করা- নিজের ব্যক্তিগত কিছু বিষয় থাকে যা চাইলেই কাউকে শেয়ার করা যায়না। অনেকেই বলে থাকেন আমার অমুক বন্ধু আমার সব কথা জানেন এবং অনেকে তার বন্ধুর সাথে এতটাই ফ্রি যে তাদের মাঝে আর লজ্জা কাজ করেনা, বন্ধুর কাছে যখন আপনি সব বলে দিলেন! সে বন্ধু আপনাকে কিভাবে নিবে একবার চিন্তা করেছেন কি? হযরত আলী বলতেন- মানুষের গোপনীয় কথা যতক্ষণ নিজের মধ্যে থাকে ততক্ষণ সে স্বাধীন, যখনই সে অন্যের কাছে বলে দেয় তখন থেকে পরাধীন। কাজেই আত্মসম্মান অক্ষুণ্ণ রাখতে ব্যক্তিগত প্রাইভেন্সি রক্ষা করা জরুরী। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোকেরা নিজের দুর্বলতা কাউকে বলে বেড়ায় না কারণ নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করা নিজেকে ছোট করা নামান্তর।
(ছ) সবকিছুতে পজিটিভ চিন্তা করা- আপনি যেমন প্রত্যাশা করেন কেউ আপনার সমন্ধে ভালো ধারণা পোষণ করুক অনুরুপভাবে সেও প্রত্যাশা করে আপনি তার সমন্ধে পজিটিভ ধারণা পোষণ করবেন। মনে রাখতে হবে নেগেটিভ কিছু সবসময় নেগেটিভ বিষয় ছড়াবে। কাউকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করলে তা থেকে বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা ছড়াবে, সম্পর্ক নষ্ট হবে, দেখা যায় নিছক বিষয় নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট কিংবা কমেন্ট করায় অনেকের সাথে অনেকের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় বরং সবার প্রতি সৌহার্দপূর্ণ মনোভাব পোষণ করলে ব্যক্তিগত সম্পর্ক উন্নয়ন হয়, তাই ব্যক্তিত্ববানরা সবকিছু পজিটিভলি চিন্তা করে।
(জ) ক্ষমতার অপব্যবহার না করা- ক্ষমতার অপব্যবহারের বেশ কিছু দিক আছে, মানুষজন নানানভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকে। নিজের মতামত অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া এতে মারাত্মক ভাবে ইমেজ ক্ষুণ্ণ হয়। নেতারা তার কর্মীদের উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়, বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে হলের বড় ভাইয়েরা সিনিয়রিটি দেখিয়ে জুনিয়রদের দিয়ে ব্যক্তিগত অনেক কাজ করিয়ে নেয়, শিক্ষকেরাও শিক্ষার্থীদের দিয়ে ব্যক্তিগত কাজ আদায় করে নেয়, সিনিয়রিটির সুযোগে( প্রশাসন, সংগঠন, সমাজ, পরিবার উক্ত ক্ষেত্রে) জুনিয়রদের চাপ দিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করা একান্তই ব্যক্তিত্বহীনতার পরিচায়ক। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোকেরা ক্ষমতার অপব্যবহার করেনা বরং পারষ্পরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে নিজের কাজ আদায় করে নেয়।
(ঝ) আত্মপ্রচার না করা- একটি প্রবাদ আছে এরকম- “সূর্য উদিত হলে আর অন্য কোন আলোর প্রয়োজন হয়না এমনিতেই মানুষ সূর্যের আলো দেখতে পারবে”। নিজের ঢোল নিজে পিটালে আত্মসম্মান থাকেনা, মানুষ আপনাকে সস্তা মনে করবে। আপনি যোগ্য হলে কিংবা ভালো কিছু করলে মানুষ এমনিতেই জানতে পারবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- নিজেরে যেন প্রচার না করি নিজের কাজে। আপনি যখন কাউকে আপনার সমন্ধে ফেসবুকে পোস্ট করতে বলবেন স্বাভাবিকভাবেই সে ব্যক্তির কাছে আপনার ব্যক্তিত্ব সস্তা হয়ে যাবে। তাই যারা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন তারা আত্মপ্রচার বিমুখ এবং স্বীয় কাজে বিশ্বাসী হয়। মনে রাখতে হবে আত্মপ্রচার কিংবা আত্মপ্রীতি একধরণের রোগ। ইসলামে আত্ম প্রচারকে রিয়া (লোক দেখানো) হারাম করা হয়েছে(মুসলিম-৫৫০২)।
মূলত গুণাবলি দ্বারাই মানুষের ব্যক্তিত্ব নির্ধারিত হয়। মানবিক গুণাবলি যে যত বেশি অর্জন করতে পারবে এবং অসৎ মানবীয় গুণাবলি থেকে যে যত বেশি বিরত থাকতে পারবে তার ব্যক্তিত্ব আকাশের উজ্জল তারকারাজির ন্যায় চতুর্দিকে দ্যোতি ছড়াবে। ব্যক্তিত্ব হলো মানব সম্পদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সম্পদ, যার মধ্যে এই সম্পদ আছে তার আর অন্য কোন সম্পদ না হলেও চলবে। তাই ব্যক্তিত্ববানরা ব্যক্তিত্বের কারণে অনেক লোভনীয় অফার প্রত্যখান করে আর তার বিপরীতে ব্যক্তিত্বহীনরা ব্যক্তিত্ব বিকিয়ে দিয়ে স্বার্থ হাসিল করে। কবির ভাষা দিয়ে শেষ করছি-
” পানির দরে বিকিয়ে দিতে পারি সব
সোনার দামেও আত্মসম্মান না
যদিও কাকফাটা রোদে তামাম দিন দাড়িয়ে থাকতে হয়
যদিও ক্ষুধায় পেট করে খা খা ”
মেহেদী হাসান
সভাপতি
ডিবেট বাংলাদেশ
(একটি জাতীয় বিতর্ক সংগঠন)