কোন কিছুতে অধৈর্য হইও না। একটু ধৈর্য ধরো সব ঠিক হয়ে যাবে।আজ আমরা এরকম আছি কাল তো আমরা এরকম নাও থাকতেপারি। সময় কখন কাকে কোথায় নিয়ে যায় কেউ তা বলতে পারে না।এক উপর আল্লাহ ছাড়া। কথাগুলো স্বামী নাদিমকে উদ্দেশ্য করে বলেসুমা।
আমি যখন কোন কিছুতে অধৈর্য হয়ে পড়ি তখন তোমার কথায় সান্ত্বনা পাই। তোমার কথায় সাহস শক্তি পাই। দেখি তুমি কোন কিছুতেঘাবড়াও না। এত সাহস শক্তি তুমি কোথা থেকে পাও জানিনা। তবে এইযে তোমার মনোবল শক্তিটা চলার পথে অনেক বড় প্রেরণা। নাদিমবলতে থাকে, তিন সন্তানের বাবা মা আমরা। ওদের জন্য কিছু একটাকরে রেখে যেতে পারলে মনে বড় শান্তি পেতাম। সুমা স্বামীকে সান্ত্বনাদিয়ে বলে, এই যে আমরা ছোট্ট রুমটায় তিন সন্তান নিয়ে থাকি।একদিন আমাদের এরকম থাকবো না। এই ঢাকা শহরে আমাদেরপাঁচতলা বাড়ি হবে। সেই বাড়ির মধ্যে থাকবে চোখ ধাঁধানো কারুকাজ। সেটা দেখে সবাই অবাক হবে।
নাদিম বউয়ের একথা উৎফুল্লহতে পারে না। সব কথা মানলেও তোমার এই কথাটা আমি মানতেপারছি না। যাদের চাল নাই চুলা নাই তারা হবে পাঁচতলা বাড়িরমালিক! এটা কোন কথা হলো? সুমা বলে, আমি এই সংসারে আসারপর এই পর্যন্ত যে কথা বলেছি তা কি সত্যি হয়নি? নাদিম বলে, তাহয়েছে কিন্তু এটা তো অবাস্তব। এমন উদ্ভট কথা মানা যায়? চেষ্টা আরপরিশ্রম করলে কোনটাই অসম্ভব না। নাদিমের কন্ঠে হতাশা, পরিশ্রমতো করতে চাই কিন্তু পরিশ্রম করার পথ তো দেখিনা। অবাস্তব হলেওকেন যেন সুমার বাড়ির স্বপ্নটা দেখতে ভালো লাগে।
নাদিমের বাড়িওয়ালা বিদেশ থাকেন। অবস্থাপন্ন ভালো মানুষ। বছরেদুই একবার সপরিবারে দেশে আসেন। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে যে যারমতো থাকে। সেখানে গৃহস্থলী কাজের জন্য একজন লোক দরকার।সুমার মনে স্বপ্ন পূরণের একটা সম্ভাবনা উঁকি দেয়। সুমা বাড়িওয়ালারসঙ্গে দেখা করে। বাড়িওয়ালা সাদিক হোসেন সুমার বিস্তারিত জানতেচান। এরপর স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করেন। স্ত্রী বলেন, পরিচিতদের মধ্যেথেকে কাউকে পাওয়া গেলে ভালই হয়। সুমাকে বলেন, আমরাচেয়েছিলাম নির্ঝঞ্ঝাট কোন মানুষ। তোমার স্বামী সন্তান নিয়ে বিশালপরিবার। এদের ছেড়ে বিদেশে গিয়ে থাকবে কি করে? তুমি যদি স্বামীসন্তান বুঝিয়ে যেতে পারো আমাদের আপত্তি নাই। নাদিম তার বউয়েরবিদেশ যাওয়ার ব্যাপার মানতে পারে না। কাজের জন্য পুরুষ মানুষবিদেশ যায়।
আর এখানে উল্টো ঘটনা। সুমা বলে, আমাদের বিয়েরপর সুযোগ পেয়েও তুমি বিদেশে গেলে না। বললে বিদেশ তোমার ভালোলাগেনা। তখন গেলে এত দিনে আমাদের অবস্থার পরিবর্তন হত।নাদিম স্ত্রীকে বোঝাতে চেষ্টা করে, আমাদের যেমন উপার্জন আছেআমরা তেমনি চলবো। তার চেয়ে বেশি আমাদের দরকার নেই। তুমিসন্তানের মা, সন্তান রেখে বিদেশ থাকবা এটা কি সন্তানের জন্য ভালোহবে? সুমা স্বামীকে বুঝায়, দেখো আমি আমার জন্য কোন কিছু করতেচাই না। আমার স্বামী সন্তান ভালো থাক আমি এটাই চাই। আমি বুঝিএই ছোট ছোট ছেলেরা মা ছাড়া কেমনে থাকবে! তারপরও তো তুমিআছো দায়িত্ববান বাবা হিসেবে। সুমা আমি তোমাকে বোঝাতে পারছিনা এই ছোট ছেলেদের নিয়ে আমি কেমনে চলবো। ওদের কি আমিসামলাতে পারবো। দেখো জানি কষ্ট হবে তারপরও কষ্ট করে একটুসামলে নিও।
আমি চাই সমাজের আর দশ জন সন্তানের মতো আমারসন্তানও বড় হোক। পলাশ, রোহিত, নাফিস তিন ছেলেকে বুঝ দেয়সুমা। বাবা, তোমাদের বাবা যা বলে, তাই তোমরা শুনবে। খাওয়া-দাওয়াকরবা, পড়ালেখা করবা। তোমাদের সুখে রাখার জন্যই আমি বিদেশেপাড়ি দিচ্ছি। ছেলেরাও মাকে বলে, আমরা তোমাকে ছাড়া কেমনেথাকবো। পারবা বাবা, পারতে যে হইবেই। সুমা স্বামী সন্তান বুঝ দিয়েবিদেশে চলে যায়। অন্তরে তার লুকানো স্বপ্ন। এই কষ্টের বিনিময়ে একটাবাড়ি হবে তার।
সুমা বিদেশ থেকে টাকা পাঠায়। সেই টাকা দিয়ে কিভাবে কি করতে হবেদিকনির্দেশনা দেয় স্বামীকে। সুমার প্রবাস জীবনে বছর ঘুরে বছরআসে। সে বুঝতে পারে তার স্বপ্ন পূরণ সীমিত আয়ে দীর্ঘকাল লেগেযাবে। সুমার কাজের প্রতি নিষ্ঠা এবং কর্তব্যবোধের কারণে সাদিকহোসেন এবং তার স্ত্রী খুবই সন্তুষ্ট ছিলেন। সুমা একদিন সাহস করেকথাটা বলে ফেলে, এখানে কাজের পর কিছু সময় তার হাতে থাকে।সুমা সেই সময়টায় একটা কিছু করতে চায় যাতে বাড়তি কিছু আয় হয়।পাশে একটা দোকানে এমন কাজ করার সুযোগ আছে। সাদিক হোসেনএবং তাঁর স্ত্রী সাগ্রহে তাতে সম্মতি দিলেন। বয়স্ক দোকান মালিকওসদয় ব্যক্তি তিনি সুমাকে কাজে নিয়োগ দিলেন। শুরু হলো সুমারজীবনে পরিশ্রম আর একাগ্রতার নতুন পর্ব। দোকানের কাজের সঙ্গেদোকান পরিচালনার ব্যাপার গুলিও সে দ্রুত রপ্ত করে ফেলে।
অল্পসময়ের মধ্যেই সে দোকান মালিকের আস্থা ভাজন হয়ে ওঠে। ভালোইচলছিল সবকিছু কিন্তু এর মধ্যে ঘটে গেল এক দুর্ঘটনা। দোকান মালিকঅসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। দোকান পরিচালনা তার পক্ষেঅসম্ভব হয়ে গেল। তিনি সুমাকে ডেকে বললেন, আমি দোকানটা বিক্রিকরতে চাই। তুমি কিনতে আগ্রহী হলে তোমাকে অগ্রাধিকার দেব। সুমাতার আর্থিক অসামর্থ্যের কথা জানায়। আপনার দোকান কেনার মতোএত টাকা আমার কাছে নাই। দোকান মালিক বলেন, সব টাকা আমারএকবারে প্রয়োজন নাই। মূল্য তুমি কিস্তিতে পরিশোধ করতে পারবে।সুমা বলে, সাদিক হোসেন এখানে আমার অভিভাবক। আমি তাঁর সঙ্গেআলাপ করে আপনাকে জানাবো। সাদিক হোসেন সজ্জন ব্যক্তি হিসেবেদোকান মালিকের পূর্ব পরিচিত। সুমার কাছ থেকে বিস্তারিত শুনেসাদিক হোসেন এবং তাঁর স্ত্রী খুশি হলেন এবং সানন্দে সম্মতি দিলেন।বিদেশে এলে অনেকের ভাগ্য খুলে যায় তুমিও দেখছি তাদের একজন।সুমা নিজের কাছে কিছু টাকা জমিয়ে রেখেছিল। সেই সঙ্গে সাদিকহোসেন কিছু টাকা দিলেন। সব মিলিয়ে বেশ বড় অঙ্কের একটা টাকাদোকান মালিককে দেওয়া হয়। অবশিষ্ট টাকা কিস্তিতে পরিশোধ করাহবে নির্ধারিত হয়। সুমা দোকান পরিচালনায় মনোনিবেশ করে।
টাকা উপার্জন সুমা এতই ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে দেশে আসার কথা মনেকরার ফুরসত পায় না। স্বামী সন্তানকে শুধু টাকা পাঠায়। তাদেরসান্নিধ্য, তাদের ভালোবাসা এটা যেন সুমা ভুলেই গেছে। পরিকল্পনাকরে সে দেশে যাবে। পরক্ষণেই দায়িত্ব পালনের চাপে সে ছিটকে পড়েসময়ের অদৃশ্য গহ্বরে। দিন মাস বছর মুহূর্তে হারিয়ে যেতে থাকে জীবনথেকে। দায়িত্ব পালনের বেড়াজালে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে জীবন। সুমারস্বপ্নের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়। সে ঢাকায় বাড়ি করে। পূরণ হয় আরোঅনেক আকাঙ্ক্ষা। সামর্থ্যের অপারগতায় আটকে ছিল যেসব। এবারসে দেশে যাবে সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সুমা দেশে আসে। দেখে তারছোট্ট সন্তানরা বড় হয়ে গেছে। মানসপটে তার ধরা আছে সন্তানদেরশৈশবের দৃশ্য। সন্তান ঠিক থাকলেও ঠিক নেই তার স্বামী, সংসার।স্বামী অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে। সুমার মাথায় আকাশভেঙ্গে পড়ে। সুমা তার স্বামী নাদিমকে বলে, এই প্রতিদান দিলে তুমিআমাকে? যেখানে স্বামী পরিশ্রম করে স্ত্রীর তার সন্তান নিয়ে বাড়িতেথাকে। আর সেখানে সেই কাজটা করলাম কিনা আমি। আমার স্বপ্নচাওয়া পাওয়া সব তোমাদের ঘিরে, তোমাকে ঘিরে। নাদিম তুমি ফিরেএসো, আমার আগের নাদিম হয়ে। নাদিমের উত্তর, ফেরার পথ আমারবন্ধ হয়ে গেছে। তোমার স্বপ্ন পূরণে তুমি স্বামী সন্তানের কথা ভুলেগেছো। তারা যে তোমার থেকে দূরে সরে গেছে সেদিকে তুমি লক্ষ্যকরনি। পৃথিবীতে শূন্যস্থান বলে কিছু নেই। সময় পূর্ণ করে শূন্যস্থান।সময়ের সঙ্গে চলার সময় মানুষকে বুঝে চলতে হয়।
তোমার অনুপস্থিতিতে এই নিঃসঙ্গ জীবনে আমাকে সময় দিয়েছে দিনা।আমার নিঃস্ব জীবন তাকে নিয়ে পাড়ি দিয়েছি। এখন আমি তাকে ছেড়েদেই কি করে!
জীবনের সর্বস্ব দিয়ে যে অধিষ্ঠিত রেখেছে তোমাদের সবাইকে। তুমিঅন্যের দিকটা দেখছো আর যে তোমার বৈধ স্ত্রী তার দিকটা তুমিদেখবে না?
তুমিও থাকো সেও থাকুক।
এটা কোন সমাধান হলো না। আর আমি আমার স্থানে অন্য কাউকেদেখতে চাই না।
তুমি দেখতে চাও কি চাও না এটা তোমার একান্ত ব্যাপার। সন্তান, বাড়িতোমার সবই তো আছে, আর আমি আমার জন্য শুধুই দিনাকে চাই।তোমার এই চাওয়াটা সমাজ কিভাবে দেখবে তা কি একবার ভেবেদেখেছো? সমাজের কথা ভেবে জীবনকে বঞ্চিত করলে কেউ কি পুরস্কৃতকরবে? সুমা মরিয়া হয়ে ওঠে। আমার জীবনেও তো শূন্যতা ছিল, আমিতো তা পূর্ণ করিনি। স্বামী সংসারে ছবি বুকে নিয়ে জীবনের সাধনাপূর্ণ করেছি। নাদিম তুমি যদি সম্পর্কে জড়াবে তাহলে সেই কথাটাআমাকে কেন বলনি? তাহলে আমি বিদেশ থেকে ফিরে আসতাম নাজীবনের এই পরাজয় প্রত্যক্ষ করতে।
তোমার আজব প্রশ্ন! কেউ কারো সাথে বলে কয়ে সম্পর্ক করেনা।
তাহলে নাদিম থাকো তুমি তোমার ডিসিশন নিয়ে। সুমা তিন ছেলেকেনিয়ে বসে, ছেলেদের মত চায় তাদের বাবা ব্যাপারে। পলাশ, রোহিত, নাফিস তিনজনেই বলে, এতে আমাদের কোন মত নেই। আর বাবা যেসিদ্ধান্ত নিয়েছে সেই ব্যাপারে কোন সন্তানেরই মত থাকে না। তোমাদেরযখন মত নেই তাহলে তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলে দেখো তাকেফিরাতে পারো কিনা।
নাদিমের তো ফেরার ইচ্ছাই নেই, দিনাও তাকে ফিরতে দিবে না। নাদিমআর দিনা বিয়ে করে। সুমা ভাবে স্বামী হয় নারীর আপন জন সেখানেতুমি আপন হয়েও হলে পর। আর যার তুমি ছিলে পর তার হলেআপন। থাকো তুমি তোমার আপনকে নিয়ে। আমি তোমার পর, পরহয়েই থাকি।
সুমা আশ্চর্য হয়ে যায় দেখে বাড়ি তার নামে নেই। স্বামী আর সন্তানেরনামে। ব্যাপারটা নিয়ে সে হতাশ হয়। স্বামীর সম্মুখীন আর হতে চায় নাসে। সে নিজে বিদেশে সেট হয় সঙ্গে তিন সন্তানকেও। বিদেশ যাওয়ারআগে সে একটা চিঠি লিখে। কর্মজীবন যুদ্ধে বিজয়ী হলেও সংসার যুদ্ধেতুমি আমাকে করলে পরাজিত। জীবনের অনুভূতির সময় পাড়ি দিলামপ্রচন্ড কর্মব্যস্ততায়। আর দশজনের মতো আমিও আপনজনের সঙ্গেসময় পাড়ি দিতে চেয়েছিলাম। এক স্বপ্ন পূর্ণ করতে গিয়ে আর এক স্বপ্নভেঙে হলো চুরমার। তুমি আমাকে করলে বঞ্চিত, প্রতারিত। জীবনেরবাকি দিনগুলো পাড়ি দিতে চাই বিদেশে সেখানেই যেন হয় আমার মৃত্যু।
আপনার মতামত লিখুন :