সুন্দর করে কথা বলতে পারা একটি আর্ট, যদি বলা হয় আর্ট কি? আর্ট মানে শিল্প, শিল্প এমন একটি ব্যাপার যা মানুষকে মুগ্ধ করে। পৃথিবীতে কথা এমন এক শক্তি যা দিয়ে পুরো পরিবেশ নিজের অনুকূলে আনা যায়। কথায় মানুষের ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। যে যত সুন্দর করে কথা বলতে পারবে সে তত দ্রুত তার কাজ আদায় করে নিতে পারবে। শুধুমাত্র কথার জাদুতে অন্যকে মুগ্ধ করা যায়, আকৃষ্ট করা যায়, কাছে টানা যায়, অন্যকে নিজ আর্দশের করিডোরে আনা যায় । পৃথিবীতে যত নেতা, বড় নেতা হয়ে দেশব্যাপী কিংবা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়েছেন এর পিছনে বক্তৃতা তথা সুন্দর করে কথা বলতে পারা নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। আব্রাহাম লিংকন বলেছিল- পৃথিবীতে যত বড় বড় নেতা ছিল বা আছে, সবাই ভালো পাবলিক স্পিকার। মার্টিন লুথার কিং, আব্রাহাম লিঙ্কন, শেখ মুজিবর রহমানসহ বিশ্বের সকল বিখ্যাত নেতাদের বক্তৃতা শুনলে বোঝা যায় যে তারা কত অসাধারণ পাবলিক স্পিকার। তারা তাদের পাবলিক স্পিকিং এর মাধ্যমে কোটি কোটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম হয়েছিল।
একজন শিক্ষক জ্ঞানগত যোগ্যতায় যতই পারদর্শী হউক না কেন ? শ্রেণি কক্ষে যদি তাঁহার উপস্থাপন শৈলির চমৎকারিত্ব দেখাতে না পারেন তাহলে শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই এটা ধরে নেন যে তিনি ভাল মানের শিক্ষক নন, কিংবা ভালো ভাবে পাঠ দানের যোগ্যতা ওনার নাই। অপ্রিয় হলেও সত্য, সমাজে অনেক যোগ্য মেধাবী ও পারদর্শী মানুষ আছে যাদের জ্ঞানগত যোগ্যতা সমৃদ্ধ কিন্তু সুন্দর ভাবে নিজের বিষয়গুলো উপস্থাপন করতে না পারার কারণে অনেক কিছু থেকে তারা বঞ্চিত হয় এবং অনেকাংশেই অবহেলিত থাকে। আবার অনেকেই ভাল বলতে পারে কিন্তু জ্ঞানগত যোগ্যতা না থাকার কারণে সমাজে তারাও উপেক্ষিত। যদি উদাহরণ দিয়ে বলি- বাজারে কিংবা বাসে ফেরিওয়ালা অনেক চমকপ্রদভাবে নিজের পণ্যের উপস্থাপন করে থাকে কিন্তু জ্ঞানগত যোগ্যতা না থাকার কারণে তাদের তেমন গ্রহণযোগ্যতা নেই। সুতরাং একদিকে যেমন সুন্দর করে বলতে পারার দক্ষতা অর্জন করতে হবে অন্যদিকে নিজের জ্ঞানগত যোগ্যতাও অর্জন করতে হবে।
আপনি যদি পাবলিক স্পিকিং এ ভালো করতে চান তাহলে প্রথমত বেশ কয়েকটি বিষয় আপনার দখলে আনতে হবে, যা আয়ত্ত করতে পারলে বক্তৃতাদানে আপনি ভালো করতে পারবেন। এই বিষয়ে যাওয়ার আগে পাবলিক স্পিকিং কি সে বিষয়ে দৃষ্টি নিবন্ধ করা যাক। পাবলিক স্পিকিং যা বক্তৃতা নামে পরিচিত, স্বাভাবিকভাবে এর অর্থ সরাসরি কথা বলার কাজ বা সরাসরি দর্শকের মুখোমুখি। মানুষের সামনে নিজেকে সেরা হিসেবে উপস্থাপন করতে হলে আপনাকে প্রথমেই যে বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হবে তা হল-
(ক) অনুশীলন- ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে – ”Practice makes a man perfect”. অনুশীলন একজন ব্যক্তিকে যোগ্য করে গড়ে তুলে। যে যত বেশি অনুশীলন করবে সে ততবেশি পারদর্শী হয়ে উঠবে অনুশীলনকৃত বিষয়ে । বিশেষ করে বক্তৃতায় এই বিষয়টা খুবই জরুরী। নিজে নিজে একা বাসায় কিংবা খেলার মাঠে বা কোন একটা নির্ধারিত সময় স্থির করে এই অনুশীলন চালিয়ে যেতে পারলেই সুবক্তা হওয়া সম্ভব। ভালো বক্তা হতে হলে অনুশীলনের বিকল্প নেই। নিয়মিত বক্তৃতা দেওয়ার মধ্য দিয়েই ব্যক্তির শব্দচয়ন, বাচনভঙ্গি, উচ্চারণ, জ্ঞানগত যোগ্যতা একটা সময়ে পরিণত রূপ লাভ করে সুবক্তা হয়ে উঠে।
(খ) জ্ঞানগত যোগ্যতা অর্জন- বর্তমান যুগ বুদ্ধি ভিত্তিক জাগরণের যুগ, মেধা দিয়েই এই প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে হয়, বেহুদা, অপ্রাসঙ্গিক কিংবা গুজামিল কথাবার্তা দিয়ে টিকে থাকা যাবেনা। কেননা সর্বত্রই চলছে মেধার লড়াই। বক্তৃতায় অপ্রাসঙ্গিক কিংবা যুক্তিহীন কথা বললে একদিকে যেমন হাসির পাত্র হতে হবে অন্যদিকে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে বক্তৃতার ময়দান থেকে বিদায় নিতে হবে। কাজেই বক্তৃতায় ভাল করতে হলে নিয়মিত বই, পত্রিকা, ম্যাগাজিন পড়তে হবে। যেখানেই জ্ঞানের উপাদান পাওয়া যাবে সেখান থেকেই কুঁড়িয়ে নিতে হবে, তাহলে বক্তৃতা কার্যকরী হবে এবং দর্শকের মাঝে এই বক্তব্যের প্রভাব লক্ষ্য করা যাবে।
এইবার আমরা আলোচনা করবো কিভাবে একজন বক্তা সুবক্তা হয়ে উঠবে এবং ভালো পাবলিক স্পিকার হয়ে উঠবে, কিভাবে প্রস্তুতি নিয়ে নিজেকে তৈরি করবে-
(১) আত্মবিশ্বাসী হওয়া- একজন বক্তাকে সবার আগে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। অনেক মানুষের সামনে কথা বলা নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জিং তবে বক্তাকে অবশ্যই আত্মবিশ্বাসী মনোভাব নিয়ে ডায়াসে দাড়াতে হবে। আমি জানি কম কিন্তু দর্শক বেশি জানে এরকম মনে করা যাবেনা, ডায়াসে দাড়িয়ে এমনটাই মনে ধারন করতে হবে। জড়তা ভুলে ভয় কে জয় করে সাবলীলভাবে উপস্থাপন করতে হবে।
(২) সূচনা- বক্তব্যের শুরুটা অন্যদের মত গতানুগতিক না করে একটু ভিন্ন ভাবে শুরু করা যেতে পারে, বিশেষ করে কোন মজার গল্প দিয়ে কিংবা কোন মনীষীর উক্তি দিয়ে বা নিজের বাস্তবিক অভিজ্ঞতা দিয়ে। তাহলে শুরুতেই দর্শকের মনযোগ নিজের দিকে নেওয়া যাবে।
(৩) বিষয় – বক্তব্যের বিষয়ে বক্তাকে আগেই ভালভাবে পড়াশোনা করতে হবে। বক্তব্যকে তথ্যবহুল করতে পড়াশোনার বিকল্প নেই, সবার ই জানা এমন বিষয়ে বক্তব্য রাখা যাবেনা, তবে যে বিষয়েই বক্তব্য দেওয়া হবে সে বিষয়ে স্টাডি করলে সে বক্তব্য সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ও তথ্যবহুল হবে। প্রয়োজনে স্ক্রিপ্ট তৈরি করে নেওয়া যেতে পারে।
(৪) শ্রোতা শনাক্তকরণ – বক্তৃতার সময় শ্রোতাদের মনযোগ ধরে রাখা অতীব জরুরী, নয়তো পরিবেশ নষ্ট হবে, শ্রোতাদের মনযোগ ধরে রাখতে মাঝেমধ্যে শ্রোতাকে প্রশ্ন করা, এমনটা করলে শ্রোতার মনোযোগও থাকবে পাশাপশি বক্তব্যও প্রাণবন্ত হবে। বক্তব্য দেয়ার সময় শ্রোতার দিকে তাকিয়ে বক্তব্য প্রদান করতে হবে, এবং অবশ্যই বক্তাকে স্বাভাবিক থাকতে হবে। মুখস্ত বক্তৃতা দেওয়া পরিহার করতে হবে। শারীরিক অঙ্গভঙ্গি অতিরঞ্জিত হওয়া যাবে না।
(৫) উচ্চারণ সচেতনতা – বক্তাকে কথা বলার সময় অবশ্যই শুদ্ধ উচ্চারণ করতে হবে, কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখতে হবে, আঞ্চলিকতা পরিহার করতে হবে, অল্পপ্রাণ ও মহাপ্রাণ এই বিষয়ে ধারণা থাকতে হবে এবং বাংলা উচ্চারণের নিয়মাবলী আগ থেকেই দখলে রাখতে হবে, কথার শব্দে আপস এন্ড ডাউন থাকতে হবে। যাকে বলা হয়ে থাকে কথার ঢেউ, যা কথাকে অলংকৃত করে। হঠাৎ মনে আসা কোন কথা বক্তব্যে
নিয়ে আসা যাবেনা, উপস্থাপনা শারীরিক অঙ্গভঙ্গির দিকে মনযোগী হতে হবে।
(৬) সময় জ্ঞান- একজন ভালো বক্তার অন্যতম গুণ হল সময়ের জ্ঞান। নির্ধারিত বিষয়ের উপরে যথাসময়ে বক্তৃতা শেষ করতে পারাও একটা যোগ্যতা। বক্তাকে অবশ্যই সময়ের দিকে খেয়াল রেখে বক্তব্য প্রদান করতে হবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই গুছানো, যৌক্তিক ও তথ্যবহুল বক্তব্য দিতে হবে, অনেকাংশে নির্ধারিত সময়ের বেশি বক্তব্য দিতে থাকলে তা গুরুত্বপূর্ণ হলেও অনেকের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেকের আবার বদঅভ্যাস আছে ডায়াসে দাঁড়ালে বা মাইক্রোফোন হাতে পেলে আর ছাড়তেই চায় না, এক্ষেত্রে লোভ সামলাতে হবে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই বক্তব্য সমাপ্ত করতে হবে।
(৭) সমাপ্তি- সবাই শুরুর মতই মুগ্ধ হয়ে যেন আপনার বক্তব্য শুনে সেজন্য উপরের নিয়মাবলীর দিকে খেয়াল রেখে আপনার বক্তব্য শেষ করতে হবে। বক্তব্যের একেবারে শেষের দিকে পুরো বক্তব্যের সারাংশ করতে হবে। একই কথার পুনরাবৃত্তি করা যাবেনা। বক্তব্যের ধারাবাহিকতা ঠিক রেখে বক্তব্যের ইতি টানতে হবে। অবশ্যই শিক্ষামূলক কিছু বলে বক্তব্যের ইতি টানতে হবে তাহলেই আপনার বক্তব্য গ্রহণযোগ্য ও ফলপ্রসূ হবে।
পাবলিক স্পিকিং নিয়ে লিখতে গেলে আরো বিস্তারিতভাবে নানাবিধ লেখা যায় কিন্তু পাঠকদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে কিনা সেদিকে লক্ষ্য রেখে শুধুমাত্র প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছি, বোধ করছি উপরিউক্ত আলোচনায় পাঠক উপকৃত হবেন এবং লেখার উপকরণগুলো আয়ত্ত করে একজন সুবক্তা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করবেন। আপনি যে পেশাই যাবেন সে পেশাতেই সুন্দর করে কথা বলার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আপনার পেশায় সফল হতে চাইলে অবশ্যই এই দক্ষতা (পাবলিক স্পিকিং) রপ্ত করুন। অনেক বেশি কাজে আসবে ।
লেখক
মুহাম্মদ মেহেদী হাসান
সাবেক সভাপতি, ডিবেট বাংলাদেশ